ড. মো. রফিকুল ইসলাম
‘আজ যত যুদ্ধবাজ দেয় হানা হামলাবাজ
আমাদের শান্তি-সুখ করতে চায় লুঠতরাজ
জোটবাধো তৈরি হও যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই,
তোলো আওয়াজ তোলো আওয়াজ…’
—সুবীর পান্ডের কথা আর সলিল চৌধুরী সুরে এই গান কেবল কাব্যিক উচ্চারণ নয় বরং এটি বিশ্বশান্তির পক্ষে মানবতার এক চিরন্তন ঘোষণা। গীতিকার এই আহ্বান জানিয়েছিলেন যুদ্ধের ধ্বংসাত্মক প্রবণতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, মানবতার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে। ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে আমরা দেখতে পাই, যুদ্ধে জয় থাকলেও মানবতা বারবার পরাজিত হয়েছে।
১৮৫৯ সালে ইতালির সলফেরিন নামক স্থানে সংঘটিত যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে একজন সুইস নাগরিক হেনরি ডুনান্ট (Henry Dunant) গভীরভাবে বিচলিত হয়ে পড়েন। আহত ও রক্তাক্ত সৈনিকদের আহাজারি তার মানবিকতাকে নাড়া দেয়। বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে তিনি আহতদের সেবা করতে এগিয়ে আসেন।
তিনি শুধু তৎকালীন একটি যুদ্ধের জন্য দায়বদ্ধ থাকেননি; তিনি চাইতেন ভবিষ্যতের যুদ্ধগুলোও যেন মানবিক ন্যূনতম নিয়মের মধ্যে থাকে। এই চিন্তা থেকেই তিনি লেখেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘A Memory of Solferino’, যেখানে যুদ্ধের সময় আহতদের সেবা ও সাধারণ মানুষের রক্ষা নিশ্চিত করতে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রস্তাব দেন।
ডুনান্টের প্রস্তাবের ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত হয় International Committee of the Red Cross (ICRC) এবং ১৮৬৪ সালে প্রণীত হয় ঐতিহাসিক জেনেভা কনভেনশন, যা আজও বিশ্বের অধিকাংশ দেশ যুদ্ধকালীন সময়ে অনুসরণ করে। এই আইন অস্ত্রধারী পক্ষগুলোর মানবতা রক্ষায় ন্যূনতম সীমারেখা নির্ধারণ করে দেয়।
এমনই আরেকটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত রেখেছেন সম্রাট অশোক। কলিঙ্গ যুদ্ধের বিভীষিকা, রক্তপাত ও মানবিক বিপর্যয় দেখে তিনি তার তরবারি ফেলে দেন, সাম্রাজ্য বিস্তারের লালসা ত্যাগ করে গ্রহণ করেন শান্তির বুদ্ধবাদী পথ। তিনি উপলব্ধি করেন—যুদ্ধ মানেই রক্ত, কান্না, ধ্বংস; আর শান্তিই প্রকৃত শক্তির প্রকাশ।
ইতিহাস এমন অনেক উদাহরণে ভরপুর, যেখানে মানুষ যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা দেখে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। সভ্যতার বিকাশে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হচ্ছে যুদ্ধ—যা ধ্বংস আনে, সভ্যতা পেছনে ফেলে, মানবতাকে ক্ষতবিক্ষত করে। যুদ্ধ কখনোই দীর্ঘমেয়াদি সমাধান দিতে পারে না, বরং ঘরে ঘরে শোক ও সহিংসতার উত্তরাধিকার রেখে যায়।
যুদ্ধকে আমরা কীভাবে দেখি?
যুদ্ধ—এই শব্দটি একদিকে যেমন বীরত্ব ও প্রতিরোধের চিত্র আঁকে, তেমনি অন্যদিকে এর অর্থ দাঁড়ায় রক্তপাত, ধ্বংস, কান্না আর মানবিক বিপর্যয়। ইতিহাসের পৃষ্ঠায় যুদ্ধ যেন নিত্যসঙ্গী হয়ে থেকেছে; কখনো রাজাদের অযৌক্তিক লালসার ফল, কখনো শাসকদের দমননীতি প্রতিহত করতে জনগণের প্রতিরোধ—প্রতিবিপ্লব হিসেবে।
আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই, দেখব অধিকাংশ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে রাষ্ট্র দখল, সীমানা প্রসারণ, প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, কিংবা ব্যক্তিগত বা রাষ্ট্রীয় হিংসা চরিতার্থ করার জন্য। কালের প্রবাহে ধর্মও হয়ে উঠেছে যুদ্ধের এক বড় উপলক্ষ।
১৮৬৪ সালে প্রণীত হয় ঐতিহাসিক জেনেভা কনভেনশন, যা আজও বিশ্বের অধিকাংশ দেশ যুদ্ধকালীন সময়ে অনুসরণ করে। এই আইন অস্ত্রধারী পক্ষগুলোর মানবতা রক্ষায় ন্যূনতম সীমারেখা নির্ধারণ করে দেয়।
ধর্মের নামে প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা, মতবাদের একচেটিয়া আধিপত্য তৈরি কিংবা মানুষকে জোর করে নির্দিষ্ট ধর্মমতে পরিচালিত করার জন্য অসংখ্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ইতিহাসে নথিভুক্ত রয়েছে। মানবসভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে, বিশেষত জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ও শিল্পবিপ্লবের পর মানুষ আশাবাদী হয়েছিল যে, যুক্তিবাদ, মানবতা ও সভ্যতা মানুষকে যুদ্ধের পথ থেকে ফিরিয়ে এনে শান্তির পথে নিয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো—যুদ্ধ থামেনি বরং তার ধরন পাল্টেছে।
বিশেষ করে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো বহু সময় নিজেদের নীতিমালা, আদর্শ ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অন্য রাষ্ট্রের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার জন্য যুদ্ধ শুরু করেছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে বা কথিত সন্ত্রাসবাদ দমনের অজুহাতে বহু দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ ও সংঘাত সংঘটিত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া ইত্যাদি তার নির্মম উদাহরণ।
বর্তমান বাস্তবতায় যুদ্ধের প্রকৃতি আরও জটিল হয়েছে। অনেক দেশে ক্ষমতা দখল ও তা ধরে রাখার জন্য শাসকগোষ্ঠী ধর্ম, জাতীয়তাবাদ বা জাতিগত পরিচয়কে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। এর ফলে অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও গৃহযুদ্ধ তৈরি হচ্ছে—যেখানে একপক্ষ শাসনের নামে দমন করে, অন্যপক্ষ প্রতিরোধের নামে অস্ত্র তুলে নেয়।
এছাড়াও ডানপন্থী, বামপন্থী ও উদারপন্থীদের মধ্যে আদর্শিক দ্বন্দ্ব, মতবাদগত সংঘর্ষ এখন আর কেবল রাজনৈতিক বিতর্কে সীমাবদ্ধ নেই—তা সমাজের গভীরে বিভাজন তৈরি করছে এবং মানবজাতিকে স্থায়ী শান্তির পথে এগিয়ে যেতে দিচ্ছে না। অতএব, যুদ্ধকে কেবল ভূখণ্ড বা অস্ত্রের সংঘর্ষ হিসেবে দেখলে হবে না। এটি ক্ষমতার, আধিপত্যের, এবং মতবাদের সংঘর্ষ—যা দিনশেষে মানুষেরই জীবন বিপন্ন করে, সমাজকে করে ক্ষতবিক্ষত।
শান্তি কী? শুধু সংঘাতের অনুপস্থিতি নয়
শান্তি—এই শব্দটি আমাদের সবার কাম্য, কাঙ্ক্ষিত ও আকাঙ্ক্ষিত। প্রত্যেক মানুষই চায় শান্তিতে বসবাস করতে, নিরাপদে বাঁচতে, স্বপ্ন ও সম্ভাবনার পথে এগিয়ে যেতে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—শান্তি মানে আসলে কী? শান্তি অধ্যয়নের অন্যতম পুরোধা, নরওয়েজীয় সমাজবিজ্ঞানী জোহান গালতুং (Johan Galtung) শান্তিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন একটি নেতিবাচক ও ইতিবাচক দ্বৈত পরিপ্রেক্ষিতে। তার মতে, শান্তির একটি মাত্রা হলো সংঘাত, সহিংসতা, যুদ্ধ ও মানবতা-বিরোধী কর্মকাণ্ডের অনুপস্থিতি—একে তিনি বলেন নেগেটিভ পিস বা নেতিবাচক শান্তি। অর্থাৎ যেখানে মারামারি নেই, সহিংসতা নেই, সশস্ত্র সংঘাত নেই—সেখানে একধরনের বাহ্যিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করে। কিন্তু গালতুং এও বলেন, সংঘাতের অনুপস্থিতি মানেই প্রকৃত শান্তি নয়।
প্রকৃত শান্তি আরও গভীর ও বহুমাত্রিক। এটি কেবল যুদ্ধ না থাকাকে বোঝায় না, বরং এটি একটি ইতিবাচক সামাজিক অবস্থা, যেখানে মানুষ ন্যায়, মর্যাদা ও সমতার ভিত্তিতে জীবনযাপন করতে পারে। এই দৃষ্টিভঙ্গিকে বলা হয় পজিটিভ পিস বা ইতিবাচক শান্তি। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন (Amartya Sen) শান্তিকে কেবল রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিষয় হিসেবে দেখেননি। বরং তিনি শান্তিকে দেখেছেন ক্ষুধামুক্তি, দারিদ্র্যমুক্তি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকারের নিশ্চয়তা এবং মানবিক বিকাশের সুযোগ হিসেবে। তার মতে, যেখানে মানুষ নিজের চাহিদা, স্বপ্ন ও সম্ভাবনা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে পারে—সেই সমাজই প্রকৃত অর্থে শান্তিপূর্ণ।
একইভাবে, সমাজবিজ্ঞানী জন বার্টন (John Barton) শান্তিকে ব্যাখ্যা করেছেন মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ ও সামাজিক ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটে। তার মতে, যদি কোনো সমাজে বৈষম্য, বঞ্চনা ও সুযোগের অসাম্য বিরাজ করে, তাহলে সেখানে বাহ্যিক শান্তি থাকলেও অন্তর্গত অশান্তি থেকে যাবে।
আজকের বিশ্বে যখন একদিকে যুদ্ধ, সহিংসতা ও রাজনৈতিক সংকট আমাদের বাস্তবতা, অন্যদিকে দারিদ্র্য, ক্ষুধা, দুর্নীতি ও বৈষম্য আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা—তখন শান্তিকে কেবল সংঘাতের অনুপস্থিতি হিসেবে দেখলে হবে না। আমাদের দরকার বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গি, যা শান্তিকে সংহতি, সহানুভূতি, মানবিকতা ও ন্যায়ের সাথে যুক্ত করে দেখে।
শান্তি মানে শুধু গুলি বন্ধ হওয়া নয়, শান্তি মানে হলো একটি এমন সমাজ গঠন, যেখানে প্রতিটি মানুষ নিজেকে নিরাপদ, মর্যাদাবান ও সম্মানিত বোধ করে। যেখানে কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয় না, খাদ্য নিয়ে হাহাকার থাকে না, এবং প্রতিটি শিশুর চোখে থাকে একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের আভাস।
কেন যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই
যুদ্ধ—একটি শব্দ, যার পেছনে লুকিয়ে থাকে অগণন প্রাণহানি, রক্ত, কান্না এবং সভ্যতার অপমান। ইতিহাসে যত বড় যুদ্ধই হোক না কেন, তার সবচেয়ে স্পষ্ট, নিষ্ঠুর ও নির্মম দিকটি হলো—মানবজীবনের বিনাশ। মানবাধিকারের মৌলিক সংজ্ঞা অনুযায়ী, ‘জীবনের অধিকার’ (right to life) প্রতিটি মানুষের জন্মগত অধিকার। অথচ যুদ্ধ এই অধিকারকে নিষ্ঠুরভাবে কেড়ে নেয়। বিশ্বজুড়ে ঘটে যাওয়া যুদ্ধগুলোতে কত মানুষের প্রাণহানি হয়েছে—তার কোনো নির্ভরযোগ্য পূর্ণাঙ্গ পরিসংখ্যান আজও নেই।
তবে ইতিহাসবিদদের অনুমান অনুযায়ী, কেবল প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেই সামরিক ও বেসামরিক মিলে প্রায় ৭০–৮০ মিলিয়ন মানুষ নিহত হয়। বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধে হারায় প্রায় ৩০ লাখ প্রাণ। আর রুয়ান্ডার গৃহযুদ্ধে প্রায় ১০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছিল মাত্র ১০০ দিনের মধ্যে। এভাবে একুশ শতকেও যুদ্ধের ভয়াবহতা থেমে নেই—যেখানে কোটি কোটি মানুষ অপ্রয়োজনীয় ও অমানবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছে।
যুদ্ধের আরও একটি তাৎক্ষণিক ফল হলো দুর্ভিক্ষ—যা মানবিক বিপর্যয়ের এক নির্মম রূপ। দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ কৃষি, সরবরাহ ব্যবস্থা ও অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেয়, যার পরিণতিতে ঘটে ভয়াবহ খাদ্য সংকট। ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত উদাহরণগুলোর একটি হলো ১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষ, যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে উৎপাদন সংকট ও ঔপনিবেশিক খাদ্যনীতির ফলে ৩০ থেকে ৪০ লাখ মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করেন। যুদ্ধ শুধু শত্রুর ওপর আঘাত হানে না, তা সমাজের প্রান্তিক, দুর্বল ও নিরীহ মানুষদের পিষে ফেলে চিরতরে।
আরও ভয়াবহ হলো যুদ্ধকালীন নারী ও শিশুর উপর সহিংসতা। শাসকের মূল লক্ষ্য যেহেতু ‘জয়লাভ’, তাই যেকোনো পন্থায় তা অর্জন করতে নারীদের ওপর চালানো হয় সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, নির্যাতন, অঙ্গহানি এবং মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার—যা মানবতার সব সীমা ছাড়িয়ে যায়। আমাদেরই ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা প্রায় ৩ লাখ নারীকে ধর্ষণ ও নির্যাতন করে। সেই ধারাবাহিকতা আজও চলমান—২০২৩-২৪ সালে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে ৫০ হাজারের বেশি নারী ও শিশু নিহত হয়েছে, যা যুদ্ধকে আরও ভয়ঙ্কর মানবিক সংকটে রূপ দিয়েছে।
শান্তি মানে শুধু গুলি বন্ধ হওয়া নয়, শান্তি মানে হলো একটি এমন সমাজ গঠন, যেখানে প্রতিটি মানুষ নিজেকে নিরাপদ, মর্যাদাবান ও সম্মানিত বোধ করে।
যুদ্ধের আরেকটি গভীর ও দুঃখজনক দিক হলো সামরিক ব্যয়ের লাগামহীন বৃদ্ধি। যখন পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত, নিরাপদ পানির অভাবে মৃত্যুবরণ করছে, তখন বিশ্ব ক্ষমতাগুলো মত্ত হয়ে আছে অস্ত্র তৈরি ও সামরিক আধিপত্যের প্রতিযোগিতায়।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (SIPRI)-এর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বৈশ্বিক সামরিক ব্যয় ৯.৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২৭১৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা প্রতিষ্ঠানটির রেকর্ডকৃত ইতিহাসে সর্বোচ্চ এবং এটি টানা দশম বছরের মতো বৃদ্ধি। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্যয়কারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যার সামরিক বাজেট ৮৯৫ বিলিয়ন ডলার। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে চীন (২৬৬.৮৫ বিলিয়ন ডলার), তৃতীয় রাশিয়া (১২৬ বিলিয়ন ডলার) এবং চতুর্থ ভারত, যার বাজেট ৭৫ বিলিয়ন ডলার। সৌদি আরবও রয়েছে শীর্ষ ব্যয়কারীদের তালিকায়, যার সামরিক বাজেট প্রায় ৭৪.৭৬ বিলিয়ন ডলার।
এই পরিসংখ্যান দেখে সহজেই অনুমান করা যায়—বিশ্ব আজ যেন যুদ্ধের জন্য উন্মাদ হয়ে উঠেছে। শান্তি ও মানবিক উন্নয়নের জন্য নয়, বরং অস্ত্র, গোলাবারুদ, পরমাণু ও ড্রোন তৈরির প্রতিযোগিতাই হয়ে উঠেছে আধুনিক সভ্যতার ‘অগ্রগতির’ মানদণ্ড। এদিকে বাস্তবতা অত্যন্ত করুণ।
পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ আজও অনাহারে দিন কাটায়। নিরাপদ পানির অভাবে প্রতি বছর মারা যায় লাখ লাখ মানুষ। শুধু আফ্রিকায়ই অর্ধেকের বেশি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে, যেখানে প্রতিটি ডলার ব্যয় হওয়া উচিত খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা ও জীবনমান উন্নয়নে। অথচ সেই অর্থ ব্যয় হচ্ছে মানুষের ধ্বংস নিশ্চিত করতে—অস্ত্র বানাতে।
এই অবস্থাকে আর কিছু নয়, আধুনিক সভ্যতার অসভ্য লীলাখেলা বললেই চলে। যেখানে মানবিকতা পরাজিত হয় রাষ্ট্রের ‘নিরাপত্তা’ নামক মোড়কে লুকিয়ে থাকা আধিপত্যবাদী মানসিকতার কাছে। এ যেন এক অজানা ভয় আর নিরাপত্তাহীনতার বৃত্তে আবদ্ধ মানবজাতির আত্মবিনাশের কাহিনি। এ অবস্থায় প্রশ্ন জাগে—আমরা কোন সভ্যতার অংশ? যুদ্ধের পেছনে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে কী আমরা সত্যিই নিরাপদ হচ্ছি, না কি প্রতিদিনই আরও অনিরাপদ, দুর্বল ও বিভক্ত হয়ে পড়ছি?
অতএব, যুদ্ধ শুধু রাজনৈতিক কিংবা ভূ-রাজনৈতিক ইস্যু নয়; এটি মানবতার বিরুদ্ধে এক নির্মম আক্রমণ। যুদ্ধ মানে শুধু বিজয় নয়, বরং মানবতার পরাজয়। যুদ্ধ কোনো রাষ্ট্রের, কোনো শক্তির একক অর্জন নয়—এটি একসাথে লাখো মায়ের কান্না, শিশুদের আর্তনাদ, ধ্বংসস্তূপে পরিণত স্বপ্ন, আর মানবিকতার লাশ।
এই প্রেক্ষাপটে, জাগ্রত বিবেককে বারবার বলতে হবে—‘কোনো যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’। শান্তি মানে নীরবতা নয়; শান্তি মানে মানবিক মূল্যবোধ, ন্যায়বিচার, সংলাপ ও সহাবস্থানের পথ। যুদ্ধ নয়, আমাদের প্রয়োজন সহানুভূতির কণ্ঠ, বোঝাপড়ার সেতু, আর মানবতার পুনরুত্থান।
ড. মো. রফিকুল ইসলাম ।। অধ্যাপক, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়